জালিমের কারাগারে বীর সিপাহসালা মুহাম্মদ মুরসির বিদায়...
৩০ বছর পর মিশরের মানুষ পেয়েছিল নতুন নেতা মোহাম্মদ মুরসিকে। মুরসির জীবনের শুরটা হয়েছিল অধ্যাপনা দিয়ে। এরপর সময়ের পালাবদলে তিনি এখন মিশরের গনতন্ত্রের পথপ্রদর্শক। ১৯৫১ সালের ২০ আগষ্ট মিশরে জন্ম গ্রহণ করেন মোহম্মদ মুরসি। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ালেখা শেষ করে উচ্চতর ডিগ্রী নিতে যান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ৩ বছর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন তিনি। তারপর ৮৫তে আবারো মিশরে ফিরে আসেন জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে। মুরসি রাজনীতির মাঠে প্রবেশ করেন তারও অনেক পরে। ২০০০-থেকে ২০০৫ পর্যন্ত পার্লামেন্টে মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। মুরসি ব্রাদারহুড দলটির উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।
২০১১ সালে ব্রাদারহুডের অর্থায়নে পরিচালিত ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির প্রধান হন মুরসি।
মুরসির স্বর্নোজ্জল অতীত যা অনুসরনীয় হতে পারে সকল শান্তিতে বিশ্বাসী মানুষের কাছেঃ-
১. প্রেসিডেন্ট মুরসী কুরআনে হাফিজঃ-
একথাটি অনেকেই জানেন না যে প্রেসিডেন্ট মুরসী সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্ত করেছেন। তার এই বিষয়টি নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবীদার।
২. তিনি বুদ্ধিমানঃ-
অনেকেরই ধারনা মুরসী অত বুদ্ধিমান ছিলেন না। তার বিরোধীরা অনবরত তার বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে তার বুদ্ধিমত্তার প্রতি প্রশ্ন তুলেছে। মুরসীর শিক্ষাগত যোগ্যতা অনেকেরই অজানা। তিনি পিএইচডি ডিগ্রীধারী, এবং জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রধান ছিলেন। তিনি আমেরিকাতে বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করেছেন এবং সেখানে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন।
৩. তিনি একটি সাধারণ অ্যাপার্টমেন্টে বাস করতেনঃ-
মিশরের প্রেসিডেন্টদের জন্য বিভিন্ন বিলাসবহুল প্রাসাদ বরাদ্দ থাকলেও প্রেসিডেন্ট মুরসী তার জন্য বরাদ্দকৃত প্রাসাদে প্রথম ঢুকেই সিদ্ধান্ত নেন তিনি সেখানে থাকবেননা। তিনি তার অফিসিয়াল কাজকর্ম প্রাসাদ থেকে পরিচালনা করলেও, তার ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে বাস করতেন। বর্তমান মুসলিম অনেক নেতাদের টয়লেটও হয়তো এই প্রেসিডেন্টের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বড় ছিল।
৪. তিনি তার মরণাপন্ন বোনের চিকিতসার জন্য কোন বাড়তি সুযোগ নিতে অস্বীকৃতি জানানঃ-
প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময় মোহম্মদ মুরসীর বোন অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তাররা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাশ্চাত্যে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন, এবং মেডিকেলের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হেলিকপ্টার ব্যবহার করার অনুমতি চান। কিন্তু মুরসী বলেন তিনি তার পরিবারের জন্য কোন বাড়তি সুবিধা নেবেন না। তার বোন সরকারী হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
৫. আজান তার বক্তৃতার আগে প্রাধান্য পেতঃ-
একদিন অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেয়ার সময় তাকে জানানো হয় নামাজের সময় হয়েছে। তিনি বক্তৃতা বন্ধ করে জোরে আজানের পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন।
৬. একজন গৃহহারা মহিলার প্রতি তার দয়াঃ-
একজন গৃহহারা বিধবা মহিলা রাস্তায় জীবন যাপন করতেন। একদিন একটি গাড়ি তার পাশে এসে থামে যার ভেতর থেকে মুরসী নেমে তাকে জিজ্ঞেস করেন কেন তিনি রাস্তায় শুয়ে আছেন। মহিলা তার দু:খের কথা খুলে বললে, তিনি আদেশ দেন মহিলাকে যেন সরকারী খরচে একটি বাড়ির ব্যবস্থা করে দেয়া হয়।
৭. স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দেশ-বিদেশ ভ্রমনঃ-
মুরসী বিভিন্ন দান-অনুদান প্রকল্পে অংশগ্রহন করতেন। দক্ষিন এশিয়ার ভয়াবহ সুনামীর পর তিনি সাহায্য মিশনে সেখানে আর্তদের সহায়তায় ছুটে গিয়েছিলেন। বাশার আল আসাদ প্রেসিডেন্ট পদ প্রাপ্ত হওয়ার পর তাকে অভিনন্দন জানালে তিনি প্রতি উত্তরে তিনি জানান, ‘আপনাকে আমি সিরিয়াবাসীর প্রকৃত প্রতিনিধি মনে করিনা’। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের হত্যাকান্ডের কারণে প্রোটোকল থাকা সত্ত্বেও তিনি তার প্রতি ভদ্রতা প্রকাশ করতে পারেন নি।
৮. দুনিয়ার সবচেয়ে কম বেতনপ্রাপ্ত নেতাঃ-
বর্তমান বিশ্বে খেলোয়াড় কিংবা নায়ক নায়িকাদের আয় শুনলেই আমাদের অবাক লাগে, আমরা ধরেই নেই রাজনৈতিক নেতাদের বেতন হবে আকাশচুম্বী। কিন্তু মুরসী ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী। তিনি নির্ধারণ করেন তার বেতন সারা বছরে হবে ১০,০০০ ডলার। তাকে অপহরণ করার সময় জানা যায়, তিনি আসলে কোন বেতনই গ্রহন করেননি। তিনি পুরো সময় বিনামূল্যে দেশের জন্য কাজ করে গেছেন।
৯. তিনি নামাজের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেনঃ-
তার বিরোধীরা প্রায়ই বলত, তার ধার্মিকতা একটি অভিনয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুরসী নামাজ নিয়মিত পড়ার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। জুমার খুতবায় তাকে কাদতেও দেখা গেছে।
১০. অফিসে তার কোন ছবি নয়ঃ-
সারাবিশ্বে আমরা দেখি নেতা নেতৃদের ছবি দিয়ে দেয়াল ভরা থাকে। মুরসী নির্বাচিত হওয়ার পর পর তিনি আদেশ জারি করেন তার কোন ছবি সরকারী ভবনে ঝোলানো যাবেনা। বরং তিনি আল্লাহর নাম দিয়ে দেয়ালগুলো ভরার আদেশ দেন।
মৃত্যুঃ-
আজ মিশরের ক্যাঙ্গারু কোর্টে তাকে নেয়া হলে শুনানী চলাকালে তিনি অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি আর রিকোভারি করতে পারেননি। তিনি আদালতে আজ টানা ২০ মিনিট বিচারককে উদ্দেশ্য করে বক্তব্য দেন। বক্তব্য দিতে দিতে তিনি একটা পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে রীতিমতো অজ্ঞান হয়ে যান। পরে তাকে আদালত থেকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। মাত্র এক বছর চার মাস তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন। ২০১১ সালে আরব বসন্তের পর ২০১২ সালে মিশরের প্রথম নির্বাচনে মুরসী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে সেনাবাহিনী অন্যায়ভাবে ক্যু করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সেই থেকে জালিমের কারাগারে মজলুম হয়ে দীর্ঘ কয়েক বছর তিনি বন্দী অবস্থায় ছিলেন।
.
উনাকে ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য জোরালো কারণ ছিল। ইসলামপন্থী মানেই খারাপ— যখন কোন রাষ্ট্র পথভ্রষ্ট হয় তখন সত্য পথের যাত্রীরা এভাবেই হারিয়ে যায়। জালিমের কারাগারে আজ মুরসিকে জীবন দিতে হলো.... ৬৭ বছর বয়সী মুরসির মৃত্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে দেশটির নাগরিকরা। মানুষ বলছে, স্বৈরাচারী শাসক হোসনি মুবারকের বিরুদ্ধে যে গণআন্দোলন করে ‘আরব বসন্ত’ এনেছিল জনগণ তা অত্যাচারী শাসক আল সিসি সরকার মেনে নিতে পারেনি। তাই হাজার হাজার গণতন্ত্র প্রিয় মানুষকে গ্রেফতার করে একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধানকে গ্রেফতার করে জেলে রাখে সরকার। দীর্ঘদিন ধরে জেলেই ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত কুরআনের হাফেজ মুহাম্মদ মুরসি। তিনি মিশরে আদর্শিক সরকার গড়তে চেয়েছিলেন।
মুরসির মৃত্যুর খবর আসতেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান বলেন,’আমার ভাই চলে গেলেন। হে আল্লাহ আমার ভাইকে বিশ্রাম দিন, শান্তিতে রাখুন।’
মুরসি ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের জনপ্রিয় নেতা। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সরকারি অনুষ্ঠানে ভারতে এসেছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্যাতিত মানুষের হয়ে তিনি কথা বলতেন। তাঁর পরিবারের সকলেই দেশের জন্য লড়াই করছেন, অনেকে জীবন দিয়েছেন।
তাঁর সংগঠন, ইখওয়ানুল মুসলেমিন সহ একাধিক সংগঠন বলছে, ড: মুরসিকে জেলে অত্যাচার করা হত।
.
একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ হিসেবে কেয়ামতের মাঠে আল্লাহ আরশের নীচে উনার স্থান হোক এবং আল্লাহ উনাকে সর্বোচ্চ জান্নাত, জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন... -আমিন
পোষ্টটি লিখতে বিভিন্ন নিউজ পেপার ও ব্লগের সহায়তা নেওয়া হয়েছে। সবাই শেয়ার করবেন...



